Wednesday, May 27, 2015

কুশল সংবাদ



এই তো বেশ আছি।
মাসান্তে পাঁচ অঙ্কে
কাজকম্মের দাম আর
মুখবইয়ের দৌলতে
ক্রমশঃ বর্ধমান আত্মপরিচয়
চেনা ছকে বাঁধান সংসার
 নিরুত্তাপ মসৃণ
নেই লক্ষ্যনির্মাণের দায়
 শুধু সূত্রমতে
এগিয়ে যাওয়া
 নির্ধারিত গন্তব্যে
প্রাপ্য বুঝে নিতে
কড়ায় – গন্ডায়।
সোনলি দুপুরে,
ডানা ভাঙ্গা চিল
পাখা ঝাপটায়...
কোথায়... কে জানে!

বেশ আছি
অন্ন-জলে, পালা- পার্বণে
বেশ আছি
 খুব বেশি একা হয়ে যাওয়া  ছাড়া
অন্য কোন অসুখও নেই

এই তো!
বেশ ভাল আছি।

আখরখেলা



আখরখেলায়
শব্দ কেটে বৃত্ত বানাই
একলাবেলায়।
মত্ত মায়ায়
জটিল যত কল্প ভাঙি
সহজ কথায়।
নিদাঘ দহন
তটভূমির জলের রেখায়
আকুল ক্ষরণ
ঝরিয়ে যায়
 উৎস হতে মোহানাতে
অবাক ধারায়
তবুও যাপন
বিজন জীবন অজানিতে
এমনি কখন
উদাস গাথায়
আবছায়া চাঁদ কাব্য ছড়ায়
হৃদয় কোষে
লগ্ন শেষে
লুপ্ত রাতের সুপ্তিসুখের  
মর্মদেশে
নির্নিমেষে
একলা খাতায় ভরে ওঠা
খড়বিচালি
ভেঙে দিয়ে আবার সাজাই
পরাণডালি।

Monday, May 25, 2015

বাবা ও রবীন্দ্রনাথ





রবীন্দ্রনাথকে আমি চোখে দেখিনি,
আমার বাবাকে দেখেছি।
বাবার হাত ধরে পথ চলতে চলতেই
আমার রবীন্দ্রনাথকে জেনে নেওয়া,
চিনে নেওয়া এবং বুঝে নিতে চাওয়া
আর প্রতিটি চিনে নেওয়ার পরেই
অপার আনন্দে ভেসে যাওয়া
ঠিক যেমন আনন্দ মেলে
অচেনা ভাষায় লেখা 
কোন অজানা স্টেশনের
নামটি পড়ে বুঝে নিতে পারলে।
সেই ছোটবেলায়,
যখন বিকেলে খেলার সময়
হঠাৎ বৃষ্টিতে খুব মন-খারাপ হত
অথবা অঙ্ক ভুল হলে
কিংবা রাতে ভাতের থালায়
মাছের টুকরো না থাকলে...
বাবা হঠাৎ বলে উঠতেন
দু-কলি রবীন্দ্রনাথ
আর আমার কাজ ছিল
কবিতার নামটি খুঁজে বের করা
এই ভীষণ দরকারী
অথবা অদরকারী কাজটি করতে করতে
মন খারাপের পাখিরা
উড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়তো
দেওয়ালে ঝোলা
রবি কবির ছবির পেছনে...

এই বড়বেলায়,
বয়স বেড়েছে
হয়তো বা বুদ্ধিও
তবু রবীন্দ্রনাথকে তেমনভাবে
বুঝতে পারিনা...
কেন কে জানে
হয়তো বাবা কাছে নেই বলে
হয়তো মন-খারাপ হওয়ার মত
মনটাই হারিয়ে গেছে  বলে...।

Monday, May 18, 2015

শিলবুড়ো




          তখন আমার তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণী।  উত্তর-পূর্ব রেলের সদর দপ্তর  মালিগাঁওয়ের এক ছোট্ট দু-কামরার রেল কোয়ার্টারে তখন আমাদের বাস- আমি,মা, বাবা তো ছিলামই,তাছাড়া ঠাকুমা, কাকু, কাকিমা,তাদের একমাত্র কন্যাও ছিলেন। আর হ্যাঁ ,আমার এক মাসি এবং কাকীমার এক বোনও এসে ছিলেন বেশ কিছুদিন...পরীক্ষা-পড়াশোনা সংক্রান্ত কোন বিষয় নিয়ে। এতগুলো লোকজন বেশ হেসে খেলে এঁটে যেতাম-ওইটুকু বাড়ীতে । অথচ এখন জনপ্রতি একখানা করে কামরা...তাতেও কুলোয় না। বাসস্থানটি  ছোট হলে কিহবে? সামনের বাগান-চত্বর এবং পেছনের খোলা উঠান জায়গার অভাব পুষিয়ে দিত। সামনে বাগান পেরিয়ে গেট, গেট পেরলেই রাস্তা আর রাস্তা পেরলেই বিশাল খোলা মাঠ।স্কুল ফেরত সে মাঠেই চলত হুটোপুটি।শীতকালে মাসভর এবং রাতভর যাত্রাপালার আসর বসত সে মাঠে । বেশির ভাগ দলই কোলকাতার, কিছু উত্তরবঙ্গের। যাত্রাদলের কুশীলবরা সব ভাগাভাগি করে আশেপাশের বাড়ীগুলোতেই থাকতেন। তাদের দেখে বড়ই অবাক হতাম। সকালে যারা নিতান্তই সাধারণ মানুষের মত ঘোরাফেরা করছেন, আলাপ পরিচয় সারছেন, দুপুরে যারা আমাদের মতই ডাল-ভাত-মাছের ঝোল খাচ্ছেন...রাতের বেলায় তারাই যে কোন মন্ত্রবলে রাজা-রাণী-উজির-বেগম সাজছেন সে এক মস্ত বড় ধাঁধা ছিল । রাতের বেলায় মঞ্চের আলো আঁধারিতে যুদ্ধ করতে করতে যে মারত এবং যে মরত পরদিন সকালেই আবার দুজনকেই মাঠের রোদে পিঠ সেঁকতে সেঁকতে একসঙ্গে চা খেতে দেখে ভারী অবাক হতাম।
          এরকমই এক পালার এক অভিনেতার থাকার জায়গা হয়েছিল আমার পাড়াতুতো সইয়ের বাসায়। তিনি যে যাত্রাপালাটিতে অভিনয় করতেন, তার নামটি এখন আর মনে নেই । কিন্তু এটা মনে আছে যে এক বুড়ো ভিখারীর চরিত্রে অভিনয় করতেন, যদিও প্রকৃত বয়স মতে তিনি তখন সদ্য যুবক। আমাদের বন্ধুদের কাছে এটাও একটা চমক ছিল। রাতের বেলার যাত্রাপালার ‘ দাদু’দিনের আলোয় কেমন করে ‘দাদা’ হয়ে যেতেন সে আমাদের মধ্যে এক বিশেষ আলোচনার বিষয় ছিল। যা হোক, এক শীতসকালে মায়ের বানানো গরম রুটি- তরকারি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে , বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দল বেঁধে  নেমে পড়েছি মাঠে । ত্রিপল ঘেরা মস্ত যাত্রা মণ্ডপটি ছিল আমাদের হুটোপাটি করার এক প্রিয় জায়গা । যাত্রা মঞ্চের পেছন দিকটাতে অনেকটা জায়গা ঘিরে বাজনদার, আলোর কারিগর , ইত্যাদিরা সকাল সকাল রান্না চড়াত...আমরা আশে পাশে ঘুর ঘুর করতাম। ওরকম লাল টকটকে ডিমের ডালনা বা কষা মাংস বাড়ীতে কস্মিনকালেও হত না। চেখে দেখতে ইচ্ছে হলেও উপায় ছিল না। চোখে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হত । তো সেদিন দেখি ,সেই যাত্রাভিনেতাটি একটি বেশ বড় শিলপাটা এবং শিল নোড়া নিয়ে বসেছে, সঙ্গে ছেনি-হাতুড়ি, চোখে কালো চশমা ---একমনে ছেনি হাতুড়ি দিয়ে শিলপাটার ওপরে ঠুকঠুক করে চলেছে...আমরা দু তিনজন কাছে এগিয়ে গেলাম...একজন তো সামনে গিয়ে উবু হয়ে বসেই পড়ল। ছেলে টি সাথে সাথে বলে উঠলো... ‘সরি যাও, সরি যাও...চোখি ধুলি পরবি...’ এক –দু পা পিছিয়ে গেলাম ...কিন্তু চলে গেলাম না...আসলে শিলপাটার ওপরে তখন ছেনি- হাতুড়ি দিয়ে লেখা হচ্ছিল খুব সুন্দর এক পদ্ম কাব্য...একটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুল, তার দুপাশে দুটি ছড়ান পাতা । আমাদের বাড়ীতেও মাঝে মাঝে শিলপাটা ধার করানো হত...কিন্তু যে করত সে তো শুধু কতগুলো সমান্তরাল বিন্দু দিয়ে যেত ...এমন ছবি তো কখনও আঁকত না...। সেদিনই মনে মনে লোকটির নাম দিয়ে ফেললাম... “শিলবুড়ো’ ...যেহেতু সে যাত্রায় বুড়ো সাজত এবং শিলপাটায় ছবি আঁকত ,তাই। আমাদের বন্ধুদের দলে ওই নামটিই মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল।
          রাতে ভাত খেয়ে ঠাকুমার পাশে লেপের তলায় শুয়ে পড়েই ঠাকুমাকে বললাম শিলবুড়োর কথা। সেইসঙ্গে আবদার...আমাদের শিলপাটাতেও ছবি আঁকাতে হবে। ঠাকুমা বললেন, সে কেন রাজি হবে? শখ করে নিজে করছিল...লোকের বাড়ী এসে হঠাৎ শিল নোড়া ধারাতে যাবে কেন? আমার বায়না...না করাতেই হবে। আচ্ছা এখন ঘুমোও...কাল দেখা যাবে  বলে ঠাকুমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।
          পরদিন সকালে আর আমাকে রোখা গেল না... ফাঁক পেতেই চলে গেলাম সেই সইয়ের বাড়ী। শিলবুড়োকে তুতিয়ে পাতিয়ে একেবারে ধরে নিয়ে এলাম সঙ্গে করে । ঘরে ঢুকে ঠাকুমাকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম , দুজনকে চেনা পরিচয় করিয়ে দিলাম যতদূর সাধ্য । ঠাকুমা তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন, শীতের রোদ মাখা খোলা উঠোনে মোড়া পেতে দিলেন । স্টিলের রেকাবিতে দিলেন ঘরে বানান নারকেল নাড়ু দুটি , দুটি মুড়ির মোয়া এবং গরম ধোঁয়া ওঠা চা । খাতির –যত্ন পেয়ে শিলবুড়ো তো মহা খুশি। খোশ মেজাজে গল্প জুড়ে দিল ঠাকুমার সঙ্গে ।খুন্তি হাতে মা-কাকিমাও মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছিলেন সে অসময়ের শীত আসরে । কথায় কথায় জানা গেল, পশ্চিমবঙ্গের কোন এক মফঃস্বল শহরের প্রান্তস্থিত এক অখ্যাত গঞ্জ এলাকায় তার বাস। তার বাবার এক ছোট্ট কিন্তু নিজস্ব মুদি দোকান  আর তার সাথে  শিল-নোড়া, ছুরি কাঁচি, বটি ইত্যাদিতে শান দেওয়ার  কারবার। সে ও ছোট থেকেই ছেনি-হাতুড়ি-পাথরের টান অনুভব করত । পড়াশোনার পাট চলছিল গড়িয়ে গড়িয়ে...তার মধ্যেই সে পাথর টুকরো জোগাড় করে ছেনি হাতুড়ি দিয়ে নানান আকৃতি  তৈরি করত ,যার কিছু কিছু বিক্রিও হয়ে যেত গঞ্জের মেলায় বা সপ্তাহান্তের হাটে।বাবার দোকানে চকোলেট  লজেঞ্চুসের বোয়মের পাশেও সাজিয়ে রাখত কিছু কিছু হাতের কাজ। গঞ্জের শেষ প্রান্তে স্থিত একটি বেশ বিখ্যাত শিব মন্দিরে দুরদুরান্ত অঞ্চলের বহু দর্শনার্থীর সমাগম ঘটত। তাদের মধ্যে অনেকেও তার হাতের জিনিস পছন্দ করে কিনে নিয়ে যেত। ঠাকুমা জানতে চাইলেন, ‘তা তুমি এই ছোট বয়সে যাত্রা দলে ভিড়লে কেমন করে?’ শুনে তো সে প্রথমে লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে মাথা নীচে করল। তারপরে যা বলল তার সারমর্ম হল যে তাদের পরিবারের প্রথা মত গোঁফের রেখা গজাতেই তার বেশ একটি মিষ্টি কিশোরীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বছরখানেক মিষ্টি বৌয়ের সঙ্গে মিষ্টি দাম্পত্যজীবন কাটানোর পর হঠাৎই তার বৌ একদিন হাওয়া হয়ে যায় ।কানাঘুসোয় সে জানতে পারে পাশের পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে নাকি তার আগে থেকেই আশনাই ছিল। ছেলেটি আবার যাত্রাদলে গান গাইত। তো যাত্রা দলের নায়িকা সাজার আশায় শিলবুড়োর মিষ্টি বৌ নাকি তার সঙ্গেই ভাগলবা হয় । আর বৌকে খুঁজে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই সে-ও একদিন যাত্রাদলে ভিড়ে যায়। ‘তো খোঁজ পেলে নাকি কিছু?’, ঠাকুমার কৌতূহল।
-না
-তবে আর কতদিন খোঁজাখুঁজি করবে? ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।
-না ঠাকুমা...মনের মধ্যি তো তার ছবি জ্বলজ্বল হয়ি আছে। ছবি মুছি গেলি তবিই ঘরপানে যাব।নাহলি ঘরে বাসায় আমার মন লাগবি না।
এইসব কথাবার্তায় আমি নিতান্তই অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। না থাকতে পেরে বলেই ফেললাম, ‘আমাদের শিলপাটায় ছবি বানিয়ে দেবে না?’ শিলবুড়ো সানন্দে রাজী হয়ে গেল। রান্নাঘরের দাওয়াতেই বসে গেল যন্ত্রপাতি নিয়ে । জিজ্ঞেস করল , ‘কিসের ছবি আঁকতি হবি দিদিমনি?’ নিঃসংকোচে বললাম ,  ‘আমার’। সে মুচকি হেসে কাজে লেগে গেল। আমি অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে থাকি। ধীরে ধীরে সেখানে ফুটে ওঠে এক ডানা মেলা পরী আকৃতি, হাতে ধরা যাদুদন্ড সমেত।
-         এটা কি আমি নাকি? এটা তো একটা পরী।
-         ওই পরীটাই তো তুমি...
-         ধ্যাত...তা কেমন করে হবে?
-         তুমি জান না দিদিমণি...সব ছোট মেয়েদের মধ্যিই একটা পরী লুকিয়ে থাকে
-         তাহলে আমার ডানা কোথায়?
-         আছি আছি...তোমার পিঠির মধ্যি গুটায়ে লুকায়ে আছি...যখন তুমি অনেক লিখাপড়া শিখি বড় হবি, তখন ডানা দুটি খুলি যাবি আর তুমি ওই মস্ত আকাশটিতি যেমন ইচ্ছা উড়ি বেড়াতি পারবা
তার কথা শুনে চাপা হাসি ঠোঁটে নিয়ে মা এসে দাঁড়ান। আমি অবিশ্বাসের চোখে মায়ের দিকে তাকাই...মা-ও বলেন... “হ্যাঁ তাইতো,তবে তারজন্য লেখাপড়া খুব মন দিয়ে করতে হবে...পরীক্ষার ফল যত ভাল হবে...ডানা তত তাড়াতাড়ি খুলবে।।”
          শিলবুড়ো তো পরীর ছবি এঁকে দিয়ে চলে গেল...শুধু পাটাতে নয়, আমার মাথাতেও। প্রায়ই ফ্রকের ওপর পিঠে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম, আমার লুকোনো ডানা পাখা মেলল কি না!
          শিলবুড়োর দল সাতদিন ধরে যাত্রাপালা করেছিল...এই সাতদিনে সে আমাদের পাড়া- প্রতিবেশে বেশ মিলে মিশে গিয়েছিল। শিলপাটাতে নক্সা বানানোর পথ ধরে গিয়ে মা- কাকিমা-বউদিদের অন্দরমহলে রান্নাঘরে একটা সহজ স্নেহের জায়গা তৈরি করে ফেলেছিল খুব কম আয়াসেই। তারই ফলশ্রুতি , সাতদিন পর তার দল যখন পাততাড়ি গোটাল, সে রয়ে গেল।
          আমাদের রেল কলোনির পেছনদিকে ছিল রেলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের বাসস্থান... অধিকাংশই দক্ষিণ ভারতের লোক। তো সেখানেই এক মাটির মেঝে, দর্মা বেড়ার দেওয়াল দেওয়া ঘর ভাড়া নিয়ে থেকে গেল সে। রেল কলোনির বাসিন্দাদের শিলপাটা ধার করে মন্দ কামাই হত না তার। কম বয়স আর মিষ্টি স্বভাবের জন্য সবারই মায়া পড়ে যেত তার ওপর ।
          এভাবেই বয়ে চলছিল নিস্তরঙ্গ জীবন। চাহিদা ছিল কম...তাই হয়ত শান্তি স্বস্তির অভাব ঘটত না। দু- এক ক্লাস উপরে উঠলাম। কাকুও পরিবার নিয়ে নিজস্ব কোয়ার্টারে পৃথগন্ন হলেন। দুই মাসী পরীক্ষান্তে ফিরে গেলেন নিজেদের যথাযথ ঠিকানায়। এর মধ্যে আমার খুব মিষ্টি একটা ছোট্ট ভাই হওয়াতে আমার পদমর্যাদা ও দায়িত্ব দুটোই কিছু পরিমাণে বেড়ে গেল। বেড়ে গেল নিজস্ব জগতের পরিধি। শিলবুড়ো প্রায় নিয়মিত আসত। ঠাকুমার সঙ্গী হয়ে বাগানে ফুলের পরিচর্যা করত, মায়ের টুকটাক ফাই ফরমাশ খাটত, কখনও বা আমার আর ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে হৈ হুজ্জোত করত। তারপর কার অলক্ষ ইঙ্গিতে অথবা হঠাৎ  অশনি সংকেতে অথবা  পূর্বনির্দিষ্ট ইতিহাসের পথ ধরে একদিন জ্বলে উঠলো আগুন । যে আগুন হঠাৎ  জ্বলে ওঠে , তা ত্থেকে আত্মরক্ষার সময়ও পাওয়া যায় না , সতর্ক হওয়ার সুযোগ ও  থাকে না...। পাশের বাড়ির যে অসমীয়া ভাষী মেয়েটির সাথে ছিল আমার আবাল্যের সখ্য, পুতুল ছেলে-মেয়ের বিয়ের সুত্রে যার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল শৈশবের মায়াময় আত্মীয়তা সে একদিন হঠাৎ আমার খেলার সঙ্গী হতে আপত্তি জানিয়ে বলে উঠল ‘তয় তো ক্যালা বঙ্গাল , বিদেশী... তোর লগত খেলিবলৈ মায়ে মানা করিছে, নাহিবি আমার তাত...’ তার এই বাক্যবন্ধের বিন্দু বিসর্গ আমি বুঝতে পারিনি... শুধু অনুভব করেছিলাম এক তীব্র যন্ত্রণা, বুঝতে পারছিলাম আমার বন্ধু হারিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছিলাম আমার শৈশব সাথীহারা হয়ে যাচ্ছে... কিন্তু কেন তা বুঝতে পারছিলাম না। আমার পুতুল মেয়ে যে ওর পুতুল ছেলের বউ হয়ে ওর কাছেই থেকে গেল, তাও তো  আর ফেরত পাবনা। বাড়ি ফিরে এসে মাকে বললাম  যতটুকু পারি, মা গম্ভীর মুখে জানালেন বাবাকে। বাবা গম্ভীরতর মুখে বললেন, ‘ মেয়েকে বারণ কর ওদের বাড়ি যেতে আর মুখ  বন্ধ রাখতে’। পর্দার আড়াল থেকে এই আদেশ শুনে বড় রাগ হয়েছিল বাবার ওপর। যে বাবাকে সর্ব মুস্কিল আসান বলে জানতাম, সকল বিপন্নতায় যিনি আমার নিশ্চিন্ত ভরসার আশ্রয়, সেই বাবাই কিনা আমার বন্ধুবিচ্ছেদের ঘটনায় চিরস্থায়িত্বের সীলমোহর লাগিয়ে দিলেন! তীব্র অভিমানে ভরে গেল মন। বিনাদোষে এ কি সাজা! তখনও তো জানতাম না আরো অনেক অভাবনীয়  দুর্ঘটনা অপেক্ষায় রয়েছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই জানতে পারলাম,ঠাকুমাকে কোলকাতায় বড়জ্যাঠার নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।হলও। এক অসহায় বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল শৈশবের দিনগুলিতে ।একে একে স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলো, গান-বাজনা সবই বন্ধ হল। সারাদিন শুধু একবুক আতঙ্ক নিয়ে জেগে থাকা, আতঙ্ক নিয়েই রাতের বিছানায় যাওয়া...অথচ তার কারণ বিন্দুবিসর্গও জানতাম বা বুঝতাম না। অবশেষে বিদ্রোহ করলাম একদিন, যেদিন মা- বাবার চাপা স্বরের কথাবার্তা কানে পড়ল...শুনলাম, আমাকেও কোলকাতায় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে। মা বাবা আর ছোট্ট ভাইটিকে  ছেড়ে আমি কোনমতেই কোথাও যাব না...পরিস্কার জানিয়ে দিলাম।
          বকা-ঝকা, নরমে-গরমে বোঝানো চলল কিছুদিন, কিন্তু আমি নিজ সংকল্পে অটল থাকলাম। পরে বুঝেছি কোন নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় তারা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শিলবুড়ো কিন্তু এতসবের মধ্যেও প্রায়ই আসত । ঠাকুমা চলে যাওয়াতে সেও দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু যখনই আসত, গল্প-হাসি-তামাশায়  ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করত।
          শিলবুড়োর বাসাখানার ঠিক পাশেই ছিল একটি ক্লাব । সদস্যরা বেশি ভাগই বাংলাভাষী । দুর্গাপূজা, কালীপূজা ,মাঝে মাঝে নাচ-গান নাটকের আসর ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের সক্রিয়তা। হঠাৎ একদিন উন্মত্ত বিভেদবুদ্ধির  আগুন লাগল সেই ক্লাবঘরটিতে...পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেটি...সেই সঙ্গে পুড়ে গেল শিলবুড়োর একার ঘর গেরস্তালি। মানুষটি প্রাণে বেঁচেছিল কিনা জানিনা...কিন্তু তারপর থেকে তাকে আর দেখিনি। মা চোখের জল মুছে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই সে  বেঁচে নেই, বেঁচে থাকলে একবারটি নিশ্চয়ই দেখা দিত।
          কালের নিয়মেই হঠাৎ জ্বলে ওঠা আগুন নিজেই একদিন স্তিমিত হয়ে এল।শুধু রেখে গেল অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন, যা অনেকাংশেই অপূরণীয়ও বটে।
          সেদিন দিশপুরের কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরছিলাম বাড়িতে। বাসে পছন্দসই সিটে গা এলিয়ে দেওয়ার পরেই সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। একঘণ্টার যাত্রাপথ তন্দ্রাছন্ন হয়েই কেটে যায় । সেদিনও তেমনি ঝিমুনি ধরেছিল। হঠাৎ বাস পরিচালকের তীব্র স্বরে তন্দ্রা ছুটে গেল...
-নহব নহব...ইঃ... বশিষ্ঠর পরা কামাখ্যা পাঁচ টকাত যাব ওলাইছে...
-পয়সা যে আর নাইরে বাপ... মা কামাখ্যিরে দেখতি যাব...এক বৃদ্ধের কাতর গলা...
ভাষার চলন আর গলার স্বরে আমার কোথায় যেন নাড়া লাগে... সচকিত হই... উৎকর্ণ হই...
-         সেইবিলাক মা-বাপ নাজানো।।ভাড়া দিয়ক... নহলে নামি দিয়ক
-         বুড়ো মানুষকে এমন বলতি হয় না বাপ। মায়ের থানে বড় মেলা দেখতি যাই, আমারে দুটো পয়সা মাফ করি নিয়ে গেলি তোমার ভাল হবি বাপ...
-         এবারে আমি রোমাঞ্চিত হয়ে প্রায় সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াই।একশো ভাগ নিশ্চিত হয়ে যাই যে এ আমাদের সেই শিলবুড়ো, উথাল পাথাল হয় অন্তরের অন্তঃস্থল... একমুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা শৈশব । নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে কন্ডাক্টরকে ডেকে শিলবুড়োর ভাড়া দিয়ে দিই আর গণ্ডগোল করতে মানা করি ।
-         মা কামাখ্যি দিদিমনির ভাল করবি...চিনতেনা পারলেও সে আমাকে আশীর্বাদ করে। আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চোখ জলে ভরে ওঠে। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকি। কখন যে ভাঙ্গাগড়, উলুবাড়ী,পল্টনবাজার একে একে পার হয়ে যাই...মনের মুকুরে শুধু তখন নানা মুখের মেলা... সেই পাশের বাড়ির সখী, কস্তা-পাড়ের সাদা শাড়ীতে ঘোমটায় ঘেরা ঠাকুমার উজ্জ্বল দুই চোখ, মায়ের হলুদ মাখা আঁচল, বাবার সাইকেল চালিয়ে অফিস যাওয়া, ভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি ভরা দুপুরবেলা... সব যেন গতজীবনের জলছবি...।কামাখ্যাগেট আসতেই সতর্ক হয়ে যাই। শিলবুড়োর পিছু পিছু নেমে পড়ি...যদি হারানো শৈশবের কিছু খণ্ড ক্ষণিকের জন্য ফিরে পাওয়া যায়,  সে আশায়।
          বাস থেকে নেমে ওর পিছু নিতে দেখে কিছুটা অবাক হল সে। জিজ্ঞেস করল- ‘দিদিমনি ও কি মেলা দেখতি যাবা?’ আমি উত্তর না দিয়ে ডেকে উঠি...শিলবুড়ো...? স্পষ্ট দেখতে পাই সে আপাদমস্তক কেঁপে উঠল... তারপর যখন ঘুরে তাকাল আমার দিকে , আমি বুঝতে পারলাম, সে চিনতে পেরেছে আমাকে, তারও বড় নিবিড়ভাবে মনে পড়ে গেছে সব কথা। হাতের তেলোয় চোখ মুছে বলল... ‘দিদিমনি তো সত্যি পরী হয়ি গেছো।‘ আমি জানতে চাইলাম... ‘কোথায় থাক কি কর এখন?’
-কি আর করব... থাকি এক ভাতের হোটেলে...রাঁধুনী দাদাকে রান্নার জোগাড় করি দি, আনাজ কাটি, বাটনা বাটি দি, বদলি দু বেলা চাট্টি ভাত খেতি পাই...
-সেদিন কি হয়েছিল শিলবুড়ো? আগুন লাগার পর...?
          স্মৃতির পাতা উলটিয়ে বলতে শুরু করে সে... ‘সে আর বল না দিদিমনি...আগুন যখন লাগি, আমি তখন ঘরে ছিলাম না...কাজে গেছিলাম । খবর পায়ি যখন ছুটতি ছুটতি আসলাম, সব শেষ।
-তারপর কোথায় গেলে? আমাদের বাড়ীতে এলে না কেন একবারও? কত ভেবেছি তোমার কথা...
-প্রাণের ডর গো দিদিমনি...প্রত্যিক মানুষ নিজের পরাণটিকে বড় মায়া করি গো দিদি... এই পরাণটা লয়ি বাঁচি থাকার জন্যি দু-দিন ইদিক –উদিক লুকায়ি থাকলাম। আমারে তো সবাই চিনত কোলকাতার মানুষ বলি...আগুন লাগালিওয়ালারা হাতে পেলি কি আমারে ছেড়ি দিত? সেই ডরেই একদিন বাস চড়ি পলায়ি আসলাম...নতুন জায়গাতি শিলপাটা ধারানোর কাজ করিছিলাম কদিন, কিন্তু জমাতি পারলাম না ...ভাষার ভয়, মরি যাওয়ার ভয়...সব মিলায়ি যেন তালগোল লাগি গেল। তারপর  একদিন এই আস্তানা খুঁজি পেলাম, আর থাকি গেলাম ...।
-নিজের বাড়ি ফিরে গেলে না কেন?
-ভাবছি গো দিদিমনি, ফিরি যাওয়ার কথাও ভাবছি। কিন্তু আমার বুকের পাটাতি ভগমান যে একজনির ছবি এমনভাবি খোদাই করি দিছেন... কোন আগুনেই তো সে ছবি পুড়ল না দিদি...বাড়ি ফিরি থাকবো কি নিয়ি?
-আর তোমার শিলপাটা ধারানোর কাজ?
- সে কথা আর কি বলি দিদিমনি...শিলপাটাই নাই...তার ধারানো...এখন তো বুতাম টিপি দিলিই বাটনা বাটা হয়ি যায়...
          আমি একটু থমকে যাই... আমার একান্তের ঘরকন্নায় ও তো ‘বুতাম টিপি’ দিয়েই মশলা বাটা হয় ...তবে কি প্রতিবার মেশিনের বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আনাজ-মশলাই নয়, পিষে যায় কোথাও কোন জীবন ও  জীবিকা, মুছে যায় কোন নিষ্পাপ শিল্প-স্বপ্ন!! কে জানে! এমন ভাবে বোতাম টিপেই  যদি মুছে ফেলা যেত সব অনভিপ্রেত দুর্ঘটনাও...।
          হাতব্যাগ খুলে যা পারি তুলে দিই তার হাতে...তারপর এগিয়ে যাই নিজের বাধ্যতামুলক গন্তব্যে...।